ঋষিদের অভিশাপ – ভগবান হনুমান সম্পর্কিত কথা
বালক হনুমান বড়ই চঞ্চল এবং দুষ্টু ছিলেন। একে তো প্রলয়ঙ্কর শঙ্করের অবতার, দ্বিতীয়তঃ কপি-শাবক, তারপর দেবতাদের দ্বারা প্রদত্ত অমোঘ বরদান। তাঁর চঞ্চলতা দেখে মাতা পিতা প্রসন্ন হতেন। হরিণের লেজ ধরে তাকে চার দিকে ঘোরানো এবং হাতিকে ধরে শক্তি সম্পর্কে অনুমান লাগানো তো প্রায় তাঁর নিত্য ক্রীড়ার অন্তর্গত ছিল। কখনো তিনি বিশাল বৃক্ষকে মূল সমেত নাড়িয়ে দিতেন। পাহাড়ের কোনো এমন শিখর ছিল না যেখানে তিনি লাফ মেরে না পৌঁছাতে পারতেন। সমস্ত অগম্য বন এবং পর্বত তাঁর চেনা জানা ছিল।
বনের প্রাণীরা প্রায় তাঁকে দেখে ভয় পেত, কিন্তু ভেতর থেকে তাকে ভালোও বাসতো। তিনি সমস্ত প্রাণীদের বন্ধু এবং রক্ষক ছিলেন। কোন সবল দুর্বলকে কষ্ট দেবে, এটা হনুমান সহ্য করতে পারতেন না। তিনি এক বৃক্ষের মাথা থেকে অন্য বৃক্ষের মাথার উপর লাফ দিয়ে দূরে অনেক যোজন চলে যেতেন। তাঁর ভারে যদি কোন বৃক্ষের ডাল ভেঙে পড়ার আশঙ্কা হত তবে তিনি নিজেকে হালকা করে নিতেন।
বরদানজনিত শক্তি দ্বারা সম্পন্ন হনুমান তপস্বী ঋষিদের আশ্রম এ চলে যেতেন এবং কিছু না কিছু এমন চপলতা করে বসতেন যাতে ঋষিদের ক্লেশ হত। একজন ঋষির আসন অন্য ঋষির সামনে রেখে দিতেন। কারোর মৃগ চর্ম ধারণ করে গাছের উপর লাফাতেন অথবা সেটিকে কোন বৃক্ষের ওপর ঝুলিয়ে দিতেন। কারোর কমন্ডলুর জল উলটে দিতেন বা কারোর কমন্ডলু ভেঙে দিতেন অথবা সেটিকে জলে ভাসিয়ে দিতেন।
হনুমান জপরত মুনিদের কোলে গিয়ে বসে পড়তেন। অহিংসাপরায়ণ মুনি ধ্যানস্থ হয়ে জপ করতে থাকতেন, কিন্তু এই বানর শিরোমণি মুনিদের দাঁড়ি টেনে পালিয়ে যেতেন। কারোর কৌপিন তো কারোর পাঠের পুঁথি নিজের দাঁত ও হাতের দ্বারা ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। এই মহাবলী পবন কুমার মহাত্মাদের যজ্ঞের উপযোগী পাত্রও নষ্ট করে দিতেন এবং খুব কষ্ট করে প্রাপ্ত অনেক বল্কল ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। ব্রহ্মা সহিত অন্য দেবতাদের দ্বারা দেওয়া বরদান এর সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে ঋষিগণ নিরুপায় ছিলেন, চুপ হয়ে থাকতেন, কিন্তু তাদের খুব ক্লেশ হত।
ধীরে ধীরে হনুমানের বয়স বিদ্যা অধ্যায়নের যোগ্য হয়ে গেছিল, কিন্তু তাঁর চঞ্চলতা একই ছিল। মাতা পিতাও বড় চিন্তিত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে অনেকভাবে বোঝালেন, অনেক প্রকার যত্ন করলেন, কিন্তু হনুমানের চঞ্চলতা কোনো ভাবে কমলো না। অতঃপর অঞ্জনা এবং বানররাজ কেসরী ঋষিদের সম্মুখে পৌছলেন। ঋষিরাও নিজেদের কষ্টগাঁথা তাদের শোনালেন। তাঁরা ঋষিদের বিনম্রতা সহিত নিবেদন করলেন-“তপোধন, আমরা এই বালককে বহু দিনের কঠোর তপস্যার প্রভাবের ফলে প্রাপ্ত করেছি। আপনারা এর ওপর অনুগ্রহ করুন। এমন কৃপা করুন, যাতে এ বিদ্যা প্রাপ্ত করতে পারে। আপনাদের করুনাতেই এর স্বভাব পরিবর্তন সম্ভব। আপনারা আমাদের দুজনের উপর দয়া করুন।
ঋষিরা ভাবলেন-“ইনি নিজের অমিত শক্তি এবং পরাক্রম নিয়ে অহংকারী। যদি ইনি নিজের শক্তি ভুলে যান তবেই এর যথার্থ হিত হতে পারে।”
কিছু বয়স্ক সমর্থ ঋষি এটিও জানতো যে এই বালক দেবতাদের হিত সাধন করবে। ইনি ভগবান শ্রী রামের অনন্য ভক্ত হবে এবং অনুগত ভক্তদের জন্য শক্তির অহংকার উচিত নয়। দরিদ্র ভাবের দ্বারাই প্রভুর কাজ সম্পন্ন হতে পারে।
এই কারণে ভৃগু এবং অঙ্গীরার বংশে উৎপন্ন ঋষিরা হনুমান কে অভিশাপ দিলেন-“ বানর বীর তুমি যে শক্তির আশ্রয় নিয়ে আমাদের বিরক্ত করছো, সেটিকে আমাদের অভিশাপ এর দ্বারা মোহিত হয়ে দীর্ঘ কাল পর্যন্ত ভুলে থাকবে। তুমি তোমার শক্তি সম্পর্কে জানতেই পারবে না।যখন কেউ তোমাকে নিজের কীর্তি স্মরণ করাবে, তখনি তোমার শক্তি বৃদ্ধি পাবে।”
তপস্বী মুনিদের এই প্রকার অভিশাপ দেওয়ার ফলে পবন কুমারের তেজ এবং অজ কমে গিয়েছিল আর তিনি অত্যন্ত সৌম্য স্বভাবের হয়ে গেছিলেন। এখন তিনি অন্য কপি কিশোরদের মত আশ্রমে শান্ত স্বভাবে বিচরণ করতেন । তাঁর মৃদুল ব্যবহারে ঋষি-মুনি রাও প্রসন্ন থাকতে লেগেছিলেন।
Translation By:
Poulami Poddar
[email protected]