কুমির অপ্সরাকে উদ্ধার – ভগবান হনুমান সম্পর্কিত কথা
রাম এবং রাবণের সেনাদের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ চলছিল। লক্ষ্মণ রাবণের পুত্র মেঘনাদের সামনে যুদ্ধরত ছিল। তখনই মেঘনাদ লক্ষণের ওপরে অমোঘ শক্তি নামক একটি অস্ত্রের প্রয়োগ করলেন, যা সোজা গিয়ে লক্ষণের বুকে বিঁধলো। এতে লক্ষণ মূর্ছিত হয়ে পৃথিবীর উপর পড়লেন। যখনই না হনুমান লক্ষণকে দেখলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর সহায়তার জন্য দৌড়লেন এবং তাঁকে বাহুতে উঠিয়ে শ্রী রামের শিবিরের দিকে প্রস্থান করলেন।
যখন শ্রীরাম হনুমানকে লক্ষণকে নিয়ে আসতে দেখলেন তাঁর মুখ মলিন হয়ে গেল। তিনি আতুর হয়ে হনুমানকে জিজ্ঞাসা করলেন-“ লক্ষণের কি হয়েছে পবনপুত্র?”
হনুমান বললেন-“ প্রভু! দুষ্ট মেঘনাদ এনার ওপর অমোঘ শক্তির প্রয়োগ করেছেন। যার কারণে লক্ষণের চেতনা লুপ্ত হয়েছে।”
শুনে শ্রীরামের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল। তিনি ভাব বিহ্বলতার সাথে নিজের চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অঙ্গদ, হনুমান, জাম্ববান, নল-নীলদের দিকে তাকালেন। তারপর সুগ্রীবকে বললেন-“ সুগ্রীব! লক্ষণের মূর্ছিত হওয়ার পর অনেক সময় ব্যতীত হয়েছে এখনো তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। আপনার সেনার মধ্যে কি এমন কোন ব্যক্তি নেই যে তাঁকে সুস্থ করতে পারে?”
শ্রীরামের বিলাপ শুনে হনুমান আর থাকতে পারলেন না। তিনি বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করলেন-“ বিভীষণ! লঙ্কায় কি এমন কোন বৈদ্য আছে যিনি লক্ষণকে সুস্থ করতে পারবেন?”
বিভীষণ বললেন-“ রাজবৈদ্য সুষেণ ভীষণই যোগ্য বৈদ্য। তিনি লক্ষণকে সুস্থ করে দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে তাঁকে এখানে কি করে নিয়ে আসা যাবে?”
হনুমান বললেন-“ আপনি আমায় শুধুমাত্র তাঁর গৃহের ঠিকানা বুঝিয়ে দিন, তাঁকে আনবার দায়িত্ব আমার।”
বিভীষণ তাঁকে সুষেণ বৈদ্যর গৃহের ঠিকানা বলে দিলেন। হনুমান সেই মুহূর্তেই লঙ্কা রওনা হয়ে গেলেন এবং শীঘ্রই সুষেণ বৈদ্যর গৃহে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি ঘুমন্ত সুষেণকে উঠালেন এবং সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে তাঁকে নিজের সাথে নিয়ে এলেন। সুষেণ লক্ষ্মণের নাড়ী পরীক্ষণ করলেন। বিবিধ প্রকারে তাঁকে পরীক্ষণ করে চিন্তাযুক্ত স্বরে বললেন-“ এনার সমস্ত শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। এই কারণে এনার চেতনা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কাল সূর্যোদয়ের আগে চিকিৎসা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।”
হনুমান বললেন-“ সেই জন্যই তো আপনাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, বৈদ্য মহাশয়। আপনি এনার চিকিৎসা করুন এবং যেভাবেই হোক না কেন এনার জ্ঞান ফেরান।”
সুষেণ বললেন-“ চিকিৎসা ঔষধ বিনা অসম্ভব। এই জরিবুটি, যার দ্বারা লক্ষণ সুস্থ হতে পারেন তা আমার কাছে উপলব্ধ নয়।”
হনুমান বললেন-“ কোথায় পাওয়া যাবে এই জরিবুটি বৈদ্য মহাশয়?”
সুষেণ বললেন-“ অনেক দূরে হিমালয় পর্বতের উপরে কৈলাস এবং মান সরোবর ঝিলের মাঝে দ্রোণাচল পর্বতের উপর। পাঁচটি জরিবুটি আছে, যার মিশ্রন বানিয়ে লক্ষণকে পান করাতে হবে। যার মধ্যে সঞ্জীবনী নামক একটি বুটি প্রমূখ।”
সুষেণের কথা শুনে বানরের দলের মধ্যে নীরবতা ছড়িয়ে পরলো। এত দূর থেকে জরিবুটি আনা, তাও সূর্যোদয়ের আগে। সবারই এই কাজটি অসম্ভব মনে হল। তখনই হনুমান আগে এগোলেন। তিনি শ্রীরামকে ধৈর্য রাখতে বলে বললেন-“ আপনি চিন্তিত হবেন না প্রভু। আমি আপনার সেবক এই কাজটিকে পূর্ণ করব।”
ইহা শুনে শ্রীরাম হনুমানকে ভাব বিভোর হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। হনুমান শ্রীরামের চরণ স্পর্শ করলেন এবং একটি লম্বা লাফ দিয়ে আকাশপথে উড়ে চললেন।
এদিকে লঙ্কায় রাবণের দূতেরা এসে বলল যে, হনুমান লক্ষণের মূর্ছা দূর করতে সঞ্জীবনী বুটি আনতে দ্রোণাচলে গিয়েছেন। ইহা শুনে রাবণ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের সহায়ক কালনেমি রাক্ষসকে ডেকে আদেশ দিলেন-“ কালনেমি এক্ষুনি দ্রোণাচলের দিকে প্রস্থান করো। হনুমান সঞ্জীবনী বুটি আনতে দ্রোণাচল পর্বতে গিয়েছেন। তুমি নিজের মায়ার দ্বারা সেখানে তাঁর আগে পৌঁছাও এবং কোনো ভাবে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত তাঁকে সেখানে আটকে রাখো। যদি সম্ভব হয় তাঁকে মেরে ফেলো।”
কালনেমি তৎক্ষণাৎ রাবণের আজ্ঞা পালন করলেন। তিনি নিজের মায়া ছড়িয়ে দিলেন এবং কথায় কথায় হনুমানের আগেই তাঁর পথে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি সেখানে একটি স্থানে মায়াবী আশ্রম বানালেন এবং স্বয়ং একজন সন্নাসীর রূপ ধারণ করে হনুমানের জন্য প্রতীক্ষা করতে বসে পড়লেন। হনুমানের পিপাসা পেয়েছিল আকাশপথে উড়তে উড়তে, তিনি নিচে একটি জলাশয়ের কিনারায় স্থিত একটি আশ্রম দেখতে পেলেন তো জল পান করার ইচ্ছায় তিনি নিচে নেমে এলেন। তিনি সাধুর বেশধারী কালনেমিকে প্রণাম করলেন এবং জল পানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।
সাধু বললেন-“ পবনপুত্র! যাত্রার ঠিক পরেই জল পান করা হানিকারক হয়। এই জলাশয়ে স্নান করে আগে ক্লান্তি দূর করো। তারপরে জল পান করে যাত্রায় রওনা হয়ে যাবে।”
হনুমান কালনেমির যোজনা অনুসারে জলাশয়ে স্নান করতে লাগলেন। এবার তিনি প্রথম ডুবই মেরেছিলেন যে একটি বিশাল কুমির তাঁর পা ধরে ফেললো এবং জলে টানতে লাগলো। বাস্তবে তা এক মাদা কুমির ছিল। হনুমান পা ঝাঁকালেন তো
তাঁর পা মাদা কুমিরের মুখ থেকে মুক্ত হয়ে গেল। এর সাথেই তিনি দ্বিতীয় পায়ের দ্বারা লাথি মারলেন। লাথির চোটে কুমির উল্টে গেল। হনুমান তাঁর দুটি মুখ ধরলেন এবং নীচ দিয়ে চিরে ফেললেন। তৎক্ষণাৎ কুমিরের প্রাণ পাখি উড়ে গেল। তখনই একটি চমৎকার হলো। সেই মাদা কুমিরের স্থানে একজন অত্যন্ত সুন্দরী অপ্সরা প্রকট হলেন।
অপ্সরা দুটি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হনুমান তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন-“ তুমি কে সুন্দরী এবং কুমিরের থেকে হঠাৎ এই রূপে পরিবর্তিত কি করে হয়ে গেলে?”
অপ্সরা বললেন-“ হে রামদূত! আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে আপনি আমাকে এই যোনি থেকে মুক্ত করেছেন। আমি ব্রহ্মলোকের অপ্সরা ধান্য মালিনী। একদা মহর্ষি অঙ্গীরা আমার ওপর রেগে গিয়ে কুমির হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। আমার অনুনয় বিনয় করার পর তিনি বলেছিলেন যে ত্রেতাযুগে এক রামদূতের দ্বারা তোর উদ্ধার হবে। তখন থেকেই আমি এই জলাশয়ে পড়ে নিজের শাপ মুক্তির জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম। আজ আপনার প্রতাপে শাপমুক্ত হয়ে গেছি।”
অপ্সরার কথা শুনে হনুমান বললেন-“ আজ তো আশ্চর্যের পর আশ্চর্য হচ্ছে। প্রথমে একজন মহাত্মার সাথে দেখা হলো এবং এখন আপনি। আমি তো আশ্রমটিকে দেখে নিজের পিপাসা মেটানোর জন্য নীচে নেমে ছিলাম।”
অপ্সরা বললেন-“ পবনপুত্র! এই আশ্রম একটি ভ্রম। তার ভেতরে যে সাধু আছে, তিনি দুর্দান্ত মায়াবী রাক্ষস কালনেমি। তিনি রাবণের গুপ্তচর। তিনি তোমায় ছলনার দ্বারা মেরে ফেলতে চায়। সাবধানে থাকো এবং ওর কমন্ডলুর জল তো একদমই পান কোরো না। ওই জলটি তীব্র বিষ। যাহা পান করার সাথে সাথেই তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে। তুমি আমার উপকার করেছ, এই কারণে আমি চাই যে এই উপকারের কিছু তো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারি।” ইহা বলে সেই অপ্সরা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
যখন হনুমান আশ্রমে পৌঁছলেন, তখন কালনেমি হেসে কমন্ডলু তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-“ স্নান সম্পূর্ণ হলে নাও, এবার এই জল পান করে পিপাসা শান্ত করো।”
হনুমান কমন্ডলু নেবার বদলে তাঁর পেটে জোরে একটি ঘুষি মারলেন, যার ফলে সেই রাক্ষস নীচে পড়ে গেলেন। তারপর তিনি তাঁকে নিজের লেজের মধ্যে জড়িয়ে ঘোরানো আরম্ভ করে দিলেন। তারপর জোরে মাটিতে ফেলে দিলেন। মাটির ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কালনেমির হাড়গোড় ভেঙে গেল। তাঁর মুখ থেকে এক তীব্র চিৎকার নির্গত হল এবং সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
“ব্যর্থই এত সময় নষ্ট হল”, ইহা ভেবে এবার পবনপুত্র আরো বেগের সাথে দ্রোণাচলের দিকে উড়ে চললেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে অত্যন্ত ঘাবড়ে গেলেন এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন,’ হে প্রভু! এখানে তো সম্পূর্ণ পর্বতের উপর রশ্মি ছড়িয়ে রয়েছে। কি করে চিনবো যে এর মধ্যে কোনটি সঞ্জীবনী বুটি?’ হনুমান কিছু মুহূর্ত এটি ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তিনি নিশ্চয় করলেন,’ এখানে দাঁড়িয়ে বুটি বাছাই করতে অনেক সময় নষ্ট হবে। প্রথমেই মায়াবীর জন্য সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এই সম্পূর্ণ পর্বতই তুলে নিচ্ছি। বৈদ্য মহাশয় এর মধ্যে থেকে স্বয়ংই সঞ্জীবনী বুটি খুঁজে নেবেন।‘
ইহা নিশ্চয় করে হনুমান সম্পূর্ণ পর্বতই তুলে নিয়ে নিজের ডান হাতের মধ্যে বসিয়ে নিলেন এবং বায়ুর বেগে পর্বত নিয়ে ফেরত চললেন। যখন তিনি অযোধ্যার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন, তখন নিচে বসে ভরত তাঁকে রাক্ষস ভেবে নিলেন এবং ধনুকের ওপর তীর উঠিয়ে হনুমানের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। তীর লাগার সাথে সাথেই হনুমান ঘায়েল হয়ে মাটির ওপর পড়ে গেলেন এবং ‘হে রাম হে রাম’ বলতে লাগলেন।
রামের নাম শুনে ভরত অবাক হলেন। তিনি হনুমানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-“ কে তুমি আর রামের নাম কি কারনে জপ করছ? তুমি কি শ্রীরামকে চেনো?“
হনুমান বললেন-“ হ্যাঁ, প্রভু রাম আমার স্বামী। আমি তাঁর দূত হনুমান।”
হনুমানের কথা শুনে ভরত দুঃখ পেয়ে বললেন-“আমি রামের ছোট ভাই ভরত। আমি তোমায় কোনো রাক্ষস ভেবে তীর ছুঁড়ে ছিলাম। আমায় ক্ষমা করে দাও। কিন্তু এটা বল যে দাদা রাম, বৌদি সীতা এবং ছোট ভাই লক্ষণ কোথায় আছেন?”
হনুমান বললেন-“ তারা ভালো নেই। লঙ্কায় রাম-রাবণের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। লক্ষ্মণ তখন মূর্ছিত হয়ে গেছিলেন। এই সঞ্জীবনী বুটি তাঁরই জন্য।”
ইহা শুনে ভরত দুঃখ পেলেন এবং সঙ্গে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, যাকে হনুমান অত্যন্ত বিনম্রতার সাথে অস্বীকার করে বললেন-“ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আর্য শ্রেষ্ঠ। ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে এই যুদ্ধে জয় প্রভু শ্রীরামেরই হবে। সমগ্র বানর সেনা তাঁর জন্য প্রাণপণে লড়াই করছে। এখন রাবণের মৃত্যু অত্যন্ত নিকটে।”
ভরত বললেন-“ পবনপুত্র! তুমি তো আহত হয়েছ। সূর্যোদয় হওয়ার সময় হয়েছে, তার আগে সঞ্জীবনী পাওয়া আবশ্যক। আমার তীরের ওপর বসে পড়ো, আমি তোমায় পর্বতসহ কিছু মুহূর্তের মধ্যে লঙ্কাপুরী পৌঁছে দিচ্ছি।”
হনুমান বললেন-“ আপনার তীরের প্রয়োজন পড়বে না। প্রভু রামের আশীর্বাদে আমার মধ্যে এত শক্তি আছে যে দ্রোণাচল তো কি এর থেকে অনেক গুন বেশি ভারী পর্বতকেও কড়ে আঙ্গুলের উপর উঠিয়ে লাখ যোজন দূর ফেলে দিতে পারি।”
হনুমানের কথা শুনে ভরত তাঁকে পূর্ন হৃদয়ে বিদায় দিলেন। হনুমান নিজের পিতার স্মরণ করতে করতে তীব্র গতিতে উড়ে চললেন এবং সূর্যোদয় হবার আগেই সঞ্জীবনীসহ লঙ্কায় এসে পৌঁছলেন। তাঁকে দেখে সমগ্র বানরদের মধ্যে উৎসাহ ছড়িয়ে পরলো। তারা সবাই খুশিতে নাচতে লাগলো। সুষেণ বৈদ্য সঞ্জীবনী বুটি বেছে নিয়ে লক্ষ্মণের চিকিৎসায় রত হলেন। কিছু সময় পরে লক্ষ্মণ চোখ খুললেন এবং রাম নাম জপতে জপতে উঠে বসলেন। শ্রীরাম হনুমানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কারণ এই চমৎকার হনুমানের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
Translation By:
Poulami Poddar
[email protected]