মাতৃ শিক্ষা – ভগবান হনুমান সম্পর্কিত কথা
বালকের ওপর সর্বাধিক প্রভাব পড়ে তার মায়ের জীবন এবং তাঁর শিক্ষার। আদর্শ মায়েরা পুত্রদের শ্রেষ্ঠ এবং আদর্শ বানায়। হনুমানের মা অঞ্জনা পরম সদাচারিণী, তপস্বিনী এবং সর্বগুণ সম্পন্ন একজন আদর্শ মা ছিলেন। তিনি নিজের লালকে প্রাপ্ত করবার জন্য যে প্রকারের তৎপরতার সাথে কঠোর তপস্যা করেছিলেন, সেই প্রকারেরই তৎপরতার সাথে তিনি নিজের প্রাণপ্রিয় বালকের জীবন নির্মাণ করবার জন্য সজাগ এবং সাবধান থাকতেন। তিনি হনুমানের বীরত্বপূর্ণ কাজ দেখে মনে মনে আনন্দিত হতেন এবং তাঁকে উৎসাহ প্রদান করতেন।
দুপুরে এবং রাত্রিতে শয়নের পূর্বে তিনি নিজের প্রিয় পুত্রকে পুরাণের কথা শোনাতেন। তিনি আদর্শ পুরুষের চরিত্র সম্পর্কে বারবার শোনাতেন এবং নিজের পুত্রের মনোযোগ সেই দিকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করতেন। তিনি মহাপুরুষদের যে চরিত্র শোনাতেন, তা পুনরায় নিজের পুত্রকেও জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাঁর পুত্র তা থেকে কি শিখতো ? সর্বজ্ঞ এবং সর্ব অন্তর্যামী শিবের থেকে গোপনীয় কি আছে? কিন্তু দুষ্টুমি করে কখনো কখনো হনুমান অজানা হবার ভান করে ঠিক উত্তর দিতেন না। তাতে তাঁর মা তাঁকে পুনরায় শুনিয়ে কণ্ঠস্থ করিয়ে দিতেন। করুণা বরুনালয়ের অবতারদের কথা হনুমানের জিহ্বার অগ্রে ছিল। সেই শ্রেষ্ঠ কথাগুলিকে তিনি নিজের সমবয়স্ক কপি-কিশোরদের অত্যন্ত প্রেম এবং উৎসাহ পূর্বক শোনাতেন।
মাতা অঞ্জনা যখন ভগবান শ্রীরামের অবতারের কথা আরম্ভ করতেন, তখন বালক হনুমানের সমস্ত ধ্যান সেই কথাগুলোর দিকেই কেন্দ্রীত হয়ে যেত। নিদ্রা তাঁর সম্মুখে আসতে পর্যন্ত পারত না। মায়ের যদি নিদ্রা আসতো, তখন হনুমান তাঁকে ঝাকিয়ে দিয়ে বলতেন-“মা! আগে বল, তারপর কি হলো?“
মা পুনরায় বলতে থাকতেন। শ্রীরামের কথা শ্রবণ করে হনুমানের তৃপ্তিই হতো না। সে মাকে বার বার শ্রীরামের কথা শোনানোর জন্য আগ্রহ করতেন। মাতা অঞ্জনা উল্লাস পূর্বক কথা শোনাতেন এবং সেই কথা শ্রবণ করে তিনি ভাব বিভোর হয়ে যেতেন। তাঁর চোখে অশ্রু ভরে আসতো। অঙ্গ ছটফট করতে লাগতো। তিনি ভাবতেন যদি আমি সেই হনুমান হতাম!
কথা শোনাতে শোনাতে মা অঞ্জনা জিজ্ঞেস করে বসতেন-” পুত্র! তুইও সেই রকমই হনুমান হবি?”
“হ্যাঁ, মা। অবশ্যই সেই হনুমান হব।” হনুমান উত্তর দিতেন।” কিন্তু শ্রীরাম এবং রাবণ কোথায়? যদি রাবণ জানকী সীতার দিকে দৃষ্টিপাতও করে, তবে আমি তাকে পিসে রেখে দেব।“
মাতা অঞ্জনা বলতেন-“পুত্র! তুইও সেই হনুমান হয়ে যা। এখনো লঙ্কায় এক রাজা রাজত্ব করছেন এবং অযোধ্যা নরেশ দশরথের পুত্রের রূপে শ্রীরামের অবতারও ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তুই শীঘ্রই বড় হয়ে যা। শ্রীরামের সহায়তা করবার জন্য বল এবং পৌরুষ আবশ্যক। তুই যথাশীঘ্রই বলবান এবং পরাক্রমশালী হয়ে যা।”
” মা! আমার মধ্যে শক্তির কমতি কোথায় আছে?” হনুমান রাত্রিতে শয্যা থেকে লাফিয়ে পড়তেন এবং নিজের ভূজদন্ড দেখিয়ে মায়ের সম্মুখে নিজেকে অমিত শক্তিশালী প্রমাণ করতে থাকতেন। মা অঞ্জনা হাসতে থাকতেন এবং তারপর নিজের প্রিয় বালক হনুমানকে কোলে নিয়ে পিঠ চাপড়াতেন তথা মধুর স্বরে প্রভুর স্তবন শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। হনুমান মাতা অঞ্জনার বুকের সঙ্গে লেগে সুখ পূর্বক ঘুমিয়ে পড়তেন।
সহজ অনুরাগে হনুমান বারবার শ্রীরামের কথা শ্রবণ করতেন। বারবার শ্রীরামের কথা শ্রবণ করার ফলে তিনি বার বার শ্রীরামকে স্মরণ এবং তাঁর চিন্তা করতেন। ফল স্বরূপ তাঁর শ্রীরামকে স্মরণ করা উত্তরোত্তর গভীর হতে শুরু করল। তিনি কখনো অরণ্যে, কখনো পর্বতের গুহায়, কখনো সমুদ্রের তটে, আবার কখনো ঘন কুঞ্জের মধ্যে ধ্যানস্থ হয়ে বসে পড়তেন। চোখ থেকে প্রেমের অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকত।
এই প্রকার ধ্যানের তন্ময়তার কারণে তাঁর নিজের ক্ষুধা এবং তৃষ্ণারও জ্ঞান থাকতো না। মাতা অঞ্জনা মধ্যান্হ এবং সায়ংকালে নিজের হৃদয়ের টুকরো হনুমানকে খুঁজতে বের হতেন। তিনি জানতেন যে আমার পুত্র কোথায় থাকতে পারে। তিনি বন, পর্বত, সমুদ্র, ঝরনা, অরণ্যে ঘুরে ঘুরে হনুমানকে খুঁজে আনতেন। তখন মায়ের আগ্রহে তাঁর মুখে খাদ্য পৌঁছোতো এবং এই ক্রম প্রতিদিন চলতে থাকত। হনুমান নিজের আরাধ্যের প্রেমে এতো মশগুল হয়ে থাকতেন যে নিজের শরীরের হুঁশও তাঁর কম থাকতো। তাঁর মুখ থেকে ‘রাম-রাম’ কেবল ‘রাম-রাম’ এরই জপ হতে থাকত।
Translation By:
Poulami Poddar
[email protected]