মুখের মধ্যে সূর্য – ভগবান হনুমান সম্পর্কিত কথা
মাতা অঞ্জনা নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্র হনুমানের লালন-পালন বড়ই মনোযোগ সহকারে করতেন। যখন হনুমান প্রসন্নতা পূর্বক খিলখিল করে হাসতেন, তখন অঞ্জনা এবং কেসরী খুবই আনন্দিত হয়ে যেতেন। হনুমানের বাল্য ক্রীড়া অত্যন্ত আকর্ষক এবং খুশিময় তো ছিলই, অদ্ভুতও ছিল।
একবার হয়েছিল কি, কপিরাজ কেসরী কোনো জায়গায় বাইরে গিয়েছিলেন। মাতা অঞ্জনাও বালককে পালঙ্কে শুইয়ে বন থেকে ফল-ফুল আনতে চলে গিয়েছিলেন। বালক হনুমানের খিদে পেয়েছিল। তিনি মাতার অনুপস্থিতিতে হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্রন্দন শুরু করেছিলেন। সহসা তাঁর দৃষ্টি পৃথিবীর দিগন্তের ওপর পড়ল। তখন অরুণোদয় হচ্ছিল। তিনি সূর্যের অরুণ বিন্দুকে লাল রঙের ফল ভাবলেন।
বায়ুদেবের বরদানের দ্বারা উৎপন্ন বালক হনুমান তৎক্ষণাৎ একটি লাফ মারলেন এবং সোজা সূর্যের দিকে উড়ে চললেন। আকাশ পথে যেতে যেতে তাঁকে অনেক দেবতা এবং যক্ষরা দেখতে পেলেন। তাঁরা সকলে বিস্মিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন- “আরে দেখো তো এই বাঁদরের বাচ্চা টাকে। সোজা ভগবান সূর্যের দিকে লাফাচ্ছে। এত বেগ তো স্বয়ং ভগবান বায়ুদেবের মধ্যেও নেই। চলো, ইন্দ্র দেবের কাছে যাই। তাঁকে এই ঘটনাটির সূচনা দেওয়া খুবই জরুরী।”
দেবতা এবং যক্ষ সুররাজ ইন্দ্রের কাছে পৌঁছলেন এবং তাঁকে সমস্ত ঘটনা বলে শোনালেন। শুনে দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোধিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন-“আমি দেখছি, কে এই বাঁদরের বাচ্চা। এখনই মজা দেখাচ্ছি তাঁকে।
বালক হনুমান সূর্যের কাছে পৌঁছলেন। তাঁকে দেখে সূর্যদেবের বড়ই বিস্ময় হলো, সাথেই তিনি কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন-“এ কে, যে সোজা আমার দিকে লাফাচ্ছে। আমার উষ্ণতার তাঁর ওপর বিন্দুমাত্রও প্রভাব পড়ছে না।”
বালক হনুমান সূর্যের কাছে পৌঁছলেন এবং সূর্যকে ধরে মুখের ভেতর রাখতে চাইলেন। এর মধ্যেই ঐরাবত হাতির ওপর চড়ে দেবরাজ ইন্দ্র সেখানে পৌঁছলেন। তাঁর সাথে অন্য অনেক দেবতারাও ছিল। ইন্দ্র বালক হনুমানকে ভয় দেখালেন-“এই বাঁদরের বাচ্চা!কে তুই? এবং এখানে কি করে পৌঁছালি?”
হনুমান বললেন-” দেখতে পাচ্ছ না, উড়ে উড়ে পৌঁছেছি। আমার খিদে পেয়েছে। আমি এই ফলটিকে খাব।”
একথা বলে বালক হনুমান সূর্যকে নিজের মুখের মধ্যে রাখলেন। হনুমানের এরকম করার সাথে সাথেই সর্বত্র অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। তা দেখে ক্রোধিত হয়ে ইন্দ্র নিজের বজ্র উঠালেন এবং হনুমানের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। বজ্র সোজা বালক হনুমানের মুখমন্ডলের পাশে থুতনিতে গিয়ে লাগলো। যার ফলে বালক হনুমানের থুতনি জখম হয়ে গেল। এবং তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। তারপর সূর্যের গোলাটি তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে এলো।
নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে বজ্রাঘাতে মূর্ছিত হতে দেখে বায়ুদেব ইন্দ্রের ওপর অত্যন্ত কুপিত হলেন। শক্তিশালী বায়ুদেব নিজের গতি থামিয়ে দিলেন এবং নিজের পুত্রকে নিয়ে পর্বতের গুহায় প্রবিষ্ট হলেন।
তারপর তো ত্রিভুবনের সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে নিঃশ্বাস ইত্যাদির সঞ্চার থেমে গেল। তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোর ভেঙে যেতে লাগলো এবং তাঁরা সকলে শুকনো কাঠের মত অবসন্ন হয়ে পড়ল। তাঁদের সমস্ত ধর্ম-কর্ম থেমে গেল।
প্রাণ সংকটের ভয় ভীত হয়ে ইন্দ্র, দেবগন, গন্ধর্ব, অসুর, নাগ প্রমুখরা জীবন রক্ষার জন্য ব্রহ্মার কাছে পৌঁছালেন। ব্রহ্মা সকলকে সাথে নিয়ে পর্বতের গুহায় পৌঁছলেন। যেখানে বায়ুদেব নিজের পুত্রকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দুঃখের সাথে অশ্রুধারা ভাসাচ্ছিলেন। মূর্ছিত হনুমানের সূর্য,অগ্নি এবং সুবর্ণের সমান অঙ্গের ক্রান্তি দেখে ব্রহ্মা চকিত হয়ে উঠলেন।
নিজের সম্মুখে ব্রহ্মাকে দেখার পর বায়ুদেব পুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেই সময় হনুমানের কানে অলৌকিক কুণ্ডল দুলছিল। তাঁর মাথার ওপর মুকুট, গলায় হার এবং দিব্য অঙ্গের উপর সুবর্ণের আভূষণ সুশোভিত ছিল। বায়ুদেবতা ব্রহ্মার চরণে লুটিয়ে পড়লেন।
ব্রহ্মা নিজের হাত দিয়ে অত্যন্ত স্নেহের সাথে বায়ুদেবকে ওঠালেন। এবং তাঁর পুত্রের অঙ্গের ওপরে নিজের কর কমল বোলাতে লাগলেন। কমল যোনির কর স্পর্শের দ্বারা বায়ুদেবের পুত্র হনুমানের মূর্ছা দূর হয়ে গেল। তিনি উঠে বসলেন। নিজের পুত্রকে জীবিত দেখে জগতের প্রাণ স্বরূপ পবনদেব আগের মত বইতে লাগলেন এবং ত্রিলোক জীবন দান প্রাপ্ত করল।
ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে হনুমানকে বর প্রদান করে বললেন-” এই বালকের উপর কখনোই ব্রহ্মশাপ লাগবে না এবং এর কোনো অঙ্গ কখনোই শস্ত্রাস্ত্র দ্বারা আহত হবে না।”
তারপর তিনি সুর সমুদয়কে বললেন-“দেবতাগণ! এই অসাধারণ বালক ভবিষ্যতে আপনাদের বড়ই হিত সাধন করবে। অতএব আপনারা একে বর প্রদান করুন।“
দেবরাজ ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ প্রসন্নতা পূর্বক হনুমানের কন্ঠে অম্লান কমলের মালা পরিয়ে বললেন- “আমার হাত থেকে নির্গত এই বজ্র দ্বারা এই বালকের থুতনি আহত হয়েছে, এই কারণে এই কপিশ্রেষ্ঠর নাম হনুমান হবে। এর অতিরিক্ত এই বালকের ওপর আমার বজ্রের কোন প্রভাব পড়বে না এবং এর শরীর আমার বজ্রের থেকেও অধিক কঠোর হবে।”
সেখানে উপস্থিত সূর্যদেব বললেন-” আমি একে নিজের তেজের শত অংশ প্রদান করছি। সাথেই নির্দিষ্ট সময়ে একে শিক্ষা প্রদান করে শাস্ত্র মর্মজ্ঞ নির্মিত করব। এ অদ্বিতীয় বিদ্বান এবং বক্তা হবে।”
বরুণদেব বললেন-” আমার পাশ এবং জলের দ্বারা এই বালক সর্বদা সুরক্ষিত থাকবে।“
যমদেব বললেন-” এ নিরোগ এবং আমার দণ্ড থেকে সর্বদা অবোধ্য থাকবে।“
পিঙ্গল বর্ণের যক্ষরাজ কুবের বললেন-“যুদ্ধে এর কখনোই বিষাদ অনুভূত হবে না। আমার গদার দ্বারা এ সুরক্ষিত তো থাকবেই, আমার যক্ষ-রাক্ষসরাও একে কখনো পরাজিত করতে পারবে না।“
ভগবান শংকর বর প্রদান করলেন-” এ আমার এবং আমার আয়ুধ থেকে সর্বদা অবোধ্য থাকবে।”
বিশ্বকর্মা বললেন-” এই বালক আমার দ্বারা নির্মিত সমস্ত দিব্য অস্ত্র থেকে সর্বদা সুরক্ষিত থেকে চির আয়ু হবে।”
এই প্রকার দেবতাদের অমোঘ বরদান দেওয়ার পর কমল যোনি ব্রহ্মা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে পুনরায় বললেন-” এ দীর্ঘায়ু, মহাত্মা তথা সকল প্রকারের ব্রহ্মদণ্ড থেকে অবোধ্য থাকবে।”
তারপর প্রসন্ন ব্রহ্মা বায়ুদেবকে বললেন-” মারুত! তোমার এই পুত্র শত্রুদের জন্য ভয়ঙ্কর এবং মিত্রদের জন্য অভয় প্রদান করার মতো হবে। একে যুদ্ধে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। এ ইচ্ছা অনুসারে রূপ ধারণ করে যেখানে চাইবে, যেতে পারবে। এর অপ্রতিরোধ্য গতি হবে। এ অত্যন্ত যশস্বী হবে এবং অদ্ভুত ও রোমাঞ্চকারী কাজ করবে।“
এই প্রকার বর প্রদান করে ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবগন তথা অসুরগণ নিজের নিজের স্থানে প্রস্থান করলেন।
Translation By:
Poulami Poddar
[email protected]